Sunday, 30 May 2021

প্রচেষ্টা ও ভুলের শিখন কাকে বলে ? প্রচেষ্টা ও ভুলের শিখনের পরীক্ষা ও বৈশিষ্ট্য এবং শিক্ষাগত তাৎপর্য আলোচনা করো । What is Trial and Error Learning ?nature of trial and error learning.

Trial and Error Learning 
প্রচেষ্টা ও ভুলের শিখন 


প্রাণী যখন কোন সমস্যার সম্মুখীন হয় তখন তার মধ্যে নিজের প্রচেষ্টায় ভুল বা অবাঞ্ছিত প্রতিক্রিয়া গুলি বর্জন করার এবং প্রয়োজনীয় প্রতিক্রিয়া গুলি আয়ত্তকরনের যে প্রচেষ্টা দেখা যায় তা-ই হলো "প্রচেষ্টা ও ভুলের শিখন"(Trial and Error Learning) । 

        প্রচেষ্টা ও ভুলের শিখন পদ্ধতির প্রবর্তক হলেন আমেরিকান মনোবিজ্ঞানীর ই. এল. থর্নডাইক। 

প্রচেষ্টা ও ভুলের শিখন সম্পর্কিত থর্নডাইকের পরীক্ষা 


প্রচেষ্টা ও ভুলের শিখন সম্পর্কে থর্নডাইক কুকুর , বিড়াল , মানুষ প্রভৃতির ওপর পরীক্ষা করেছিলেন তবে ক্ষুধার্ত বিড়ালের উপর তার পরীক্ষাটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। 

           মনোবিদ থর্নডাইক একটি ক্ষুধার্ত বিড়ালকে খাঁচার মধ্যে রেখে খাঁচাটি বন্ধ করে দিলেন এবং খাঁচার বাইরে এক টুকরো খাদ্যবস্তু ( মাছ ) রেখে দিলেন । বিড়ালটি খাঁচা থেকে বেরিয়ে খাদ্যবস্তু পাওয়ার জন্য বারবার এলোমেলোভাবে প্রচেষ্টা করতে লাগলো। এই অবস্থায় তিনি খাঁচার ভেতরের বিড়ালের আচরণের বিশেষ বৈশিষ্ট্য গুলি লক্ষ্য করলেন। এখানে যে বাক্সটি বা খাঁচাটি বা যন্ত্রটি ব্যবহার করা হয়েছে তাকে  "পাজল বক্স" বলে ।


থনডাইকের পরীক্ষার চিত্র : পাজল বক্স 

               প্রথম পর্যায়ে থর্নডাইক দেখলেন বিড়ালটি বেশ কিছুক্ষণ লক্ষ্যবস্তুটিকে পাওয়ার জন্য উদ্দেশ্যহীনভাবে খাঁচা থেকে বেরোনোর প্রচেষ্টা করতে করতে খাঁচার ছিটকানিটা বিড়ালের পা পড়ে যায় এবং খাঁচার ছিটকিনি খুলে যায় । ছিটকিনি খুলে যাওয়া মাত্রই বিড়ালটি বাইরে এসে খাদ্যবস্তু পেতে সমর্থ হল ।

             দ্বিতীয় পর্যায়ে বিড়ালটিকে একইভাবে খাঁচায় বন্ধ করে খাঁচার বাইরে খাবার দিয়ে রাখেন । তখনই দেখা গেল বিড়ালটি খাঁচার মধ্যে থেকে বেরিয়ে খাদ্যবস্তু পাওয়ার জন্য পরবর্তী অবস্থার তুলনায় কম ইতস্তত লাফালাফি ছোটাছুটি করতে করতে হঠাৎ তার পা ছিটকিনি তে পড়ে যাওয়াই ছিটকিনি খুলে যায় এবং বাইরে এসে খাদ্যবস্তু লাভ করে। এখানে উল্লেখ্য যে , দ্বিতীয় অবস্থায় বিড়ালটি ভুলের প্রচেষ্টা প্রথম অবস্থা থেকে অনেক কম করেছে।

          তৃতীয় পর্যায়ে আবার যখন পরীক্ষাটি পুনরাবৃত্তি করা হলো দেখা গেল বিড়ালটি একটিও ভুল প্রচেষ্টা না করে অল্প সময়ে সঠিক প্রচেষ্টা দ্বারা খাঁচা থেকে বেরিয়ে খাদ্যবস্তু পেতে সমর্থ হল। দেখা গেল এক্ষেত্রে বিড়ালটি একটিও ভুল প্রচেষ্টা না করে খাঁচা থেকে বেরিয়ে এলো, এইভাবে প্রচেষ্টা ও ভুলের মাধ্যমে প্রানীর শিখন ঘটে। 


  প্রচেষ্টা ও ভুলের শিখনের : টাইম কার্ভ 


            প্রচেষ্টা ও ভুলের শিখনের এই পরীক্ষাতে মনোবিজ্ঞানী থর্নডাইক ভুল ও সঠিক প্রচেষ্টা পরিমাপের জন্য যে লেখচিত্র বা গ্রাফ ব্যবহার করেছেন তাকেই "টাইম কার্ভ" বা "সময় লেখচিত্র" বলে।   

থর্নডাইকের পরীক্ষায় প্রাপ্ত শিখন প্রক্রিয়ার স্তর : 
থর্নডাইকের পরীক্ষার ফলাফল গুলি বিশ্লেষণ করলে শিখন প্রক্রিয়ার সব কটি স্তর পাওয়া যায় ।
 এগুলি হল - 
 1. তাড়না , 
 2. লক্ষ্য , 
 3. বাধা , 
 4. উদ্দেশ্যহীন প্রচেষ্টা , 
 5. হঠাৎ সাফল্য , 
6. সঠিক পদ্ধতি নির্বাচন , 
 7. সঠিক পদ্ধতি স্থিরীকরণ বা শিখন ।

Nature characteristics of trial and error learning    
প্রচেষ্টা ও ভুলের মাধ্যমে শিখনের বৈশিষ্ট্য 


থর্নডাইকের মতের প্রচেষ্টা ও ভুলের শিখন হল একটি যান্ত্রিক অনুশীলন নির্ভর প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ার ফলে প্রাণের প্রচেষ্টা গুলির মধ্যে থেকে ভুল প্রচেষ্টাগুলো ক্রমশ হ্রাস পায় এবং সঠিক প্রচেষ্টাটি ক্রমশ নির্দিষ্ট হয়। এইভাবে যে শিখন হয় তাকেই "প্রচেষ্টা ও ভুলের শিখন কৌশল বলে" । এই পদ্ধতিটি বিশ্লেষণ করলে যে বৈশিষ্ট্য গুলি পাওয়া যায় সেগুলো নিম্নে আলোচনা করা হল - 

1. শিক্ষার্থীদের সক্রিয়তা এবং চাহিদার ওপর নির্ভরশীলতা : এই শিখন পদ্ধতিটি শিক্ষার্থীর সক্রিয়তার ওপর নির্ভর করে আর শিক্ষার্থীর সক্রিয়তার জন্য প্রয়োজন হয় অভাববোধ বা চাহিদা। শিক্ষার্থীর চাহিদা বা অভাববোধ না থাকলে এই শিখন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা সম্ভব নয় । ঠিক যেমন - থর্নডাইকের পরীক্ষাটিতে যদি বিড়ালটি ক্ষুধার্ত না হতো তাহলে খাদ্যের জন্য বাইরে আসছে সক্রিয় হতো না।

2. লক্ষ্য সম্পর্কে ধারণা : প্রচেষ্টা ও ভুলের শিখন কৌশলের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল লক্ষ্য সম্পর্কে শিক্ষার্থীরা স্পষ্ট ধারণা থাকা প্রয়োজন। 

3. যান্ত্রিকতা : প্রচেষ্টা ও ভুলের শিখন কৌশলের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বৈশিষ্ট্য হল যান্ত্রিকতা। শিক্ষার্থীর যান্ত্রিক উপায়ে ভুল প্রচেষ্টাগুলো বাতিল করে এবং সঠিক প্রক্রিয়া গুলি বা প্রচেষ্টাগুলি নির্দিষ্ট করে।

4. পুনরাবৃত্তি: থর্নডাইকের মতে, উদ্দীপক ও প্রক্রিয়ার মধ্যে যথাযথ সংযোগ স্থাপনই হল শিখন। তাই এই প্রক্রিয়ায় উদ্দীপক ও প্রক্রিয়ার মধ্যে বারবার সংযোগ ঘটিয়ে উপযুক্ত প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করা হয় যা প্রচেষ্টা ও ভুলের শিখন কৌশলের বৈশিষ্ট্য।

5. ক্রমহ্রাস : প্রচেষ্টা ও ভুলের শিখন কৌশলের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল, ভুল প্রচেষ্টা গুলি ক্রমশ হ্রাস পায় অর্থাৎ প্রচেষ্টা সংখ্যা এবং সময় ক্রমশ হ্রাস পায়।

6. বহুমুখী প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি : প্রচেষ্টা ও ভুলের শিখন কৌশল এর সময় প্রাণী একই পরিস্থিতিতে নানারকমের প্রতিক্রিয়া করে এবং শিখন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় যা প্রচেষ্টা ও ভুলের শিখন কৌশল এর বৈশিষ্ট্য।

7.  প্রস্তুতির প্রয়োজনীয়তা : এই প্রকার শিখনের প্রাণীর শিক্ষার্থীর মানসিক ও দৈহিক দিক থেকে প্রস্তুতির প্রয়োজন হয়।

8. সর্বজনীনতা : প্রচেষ্টা ও ভুলের শিখন কৌশল এর একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল , সর্বজনীনতা। অর্থাৎ মানুষ সহ অন্যান্য প্রাণী বিভিন্ন সমস্যামূলক এবং জটিল পরিস্থিতিতে প্রচেষ্টা ও ভুলের শিখন কৌশলের সাহায্য নেয়।

9. জানা থেকে অজানা : এই শিখন কৌশল এর সাহায্যে শিক্ষার্থীর ক্রমশ জানা থেকে অজানা দিকে অগ্রসর হয় এবং সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করে।
   

Educational Implications of Trial and Error Learning 
প্রচেষ্টা ও ভুলের শিখন এর শিক্ষাগত তাৎপর্য বা গুরুত্ব 


মনোবিজ্ঞানী থর্নডাইকের প্রচেষ্টা ও ভুলের শিখন শিক্ষা জগতের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। প্রচেষ্টা ও ভুলের শিখন তত্ত্বের শিক্ষাগত তাৎপর্য নিম্নে আলোচনা করা হল - 

1. শিক্ষকের দায়িত্ব বৃদ্ধি : শিক্ষক মহাশয় শিক্ষার্থীদের ভুল প্রচেষ্টাগুলি দেখিয়ে দেবেন এবং শিক্ষার্থীরা নিজের প্রচেষ্টায় সঠিক প্রচেষ্টাগুলো আয়ত্ত করবে যা শিক্ষাক্ষেত্রে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। 

2. শিক্ষার্থীর প্রস্তুতির উপর গুরুত্ব প্রদান : এই শিখন কৌশলের সাহায্যে বোঝা যায় শিখনের সাফল্য নির্ভর করে শিক্ষার্থীর মানসিক, দৈহিক, প্রাক্ষোভিক প্রস্তুতির উপর। শিক্ষার্থীর যদি কোনরকম ভাবে প্রস্তুত না থাকে তাহলে শিখন প্রক্রিয়া সম্ভব নয় যা , এই শিখন প্রক্রিয়ার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক।

3. পাঠ্য বিষয় কে আনন্দদায়ক করে তোলা : শিক্ষার্থীর পাঠ্যবিষয় যত বেশী আনন্দদায়ক হবে শিখন প্রক্রিয়া তত সহজ হবে । শিক্ষার্থীর পাঠ্যবিষয় কে এমন ভাবে উপস্থাপিত করতে হবে যার ফলে শিক্ষার্থীরা বিরক্তিবোধ না হয়ে নিজের থেকেই শেখার তাগিদ অনুভব করে এবং শিক্ষার্থীরা ভুল প্রচেষ্টাগুলো বাদ দিয়ে সঠিক প্রচেষ্টা আয়ত্ত করতে পারে।

4. বারবার অনুশীলন : শিখন প্রক্রিয়া অনুশীলনের উপর নির্ভরশীল। শিক্ষার্থীরা যত বেশি অনুশীলন করবে তত বেশি সেই বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করতে পারবে । তবে অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে এই অনুশীলন যেন যান্ত্রিক না হয়।

5. কর্মের মাধ্যমে শিখন : থর্নডাইকের শিখন কৌশলের কর্মের মাধ্যমে শিখনের উপর অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

6. সহজ প্রক্রিয়া : এই শিখন কৌশল প্রক্রিয়ায় যেহেতু উন্নত মানসিক প্রক্রিয়ার সাহায্য নেওয়া হয় না , কেবলমাত্র প্রচেষ্টা ও ভুলের সাহায্যেই এই শিখন প্রক্রিয়া ঘটে তাই শিক্ষা ক্ষেত্রে এই প্রক্রিয়াকে প্রয়োগ করা অপেক্ষাকৃত সহজ।

7. বাস্তবমুখী : এই শিখন প্রক্রিয়ার সাহায্যে শিক্ষার্থীর বিভিন্ন বাস্তবমুখী সমস্যার সমাধান করে এবং তা থেকে জ্ঞান অর্জন করতে পারে।

8. পূর্ব অভিজ্ঞতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ : এই ধরনের শিখনের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা পূর্ব অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে বর্তমান সমস্যার সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে এবং  সমাধান করতে পারে ।

          সুতরাং উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলতে পারি যে, শিক্ষাক্ষেত্রে প্রচেষ্টা ও ভুলের শিখন কৌশল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অন্যান্য শিখন প্রক্রিয়ার তুলনায় অপেক্ষাকৃত সহজ শিখন কৌশল হল প্রচেষ্টা ও ভুলের শিখন । যা শিক্ষার্থীর নিজের প্রচেষ্টায় বিভিন্ন বাস্তব সমস্যার সমাধান করতে শেখায়। বর্তমানে শিক্ষাক্ষেত্রে বিভিন্নভাবে এই প্রচেষ্টা ও ভুলের শিখন কৌশলকে ব্যাবহার করা হয়।








2 comments:

মুদালিয়ার কমিশন (1952-53) Mudaliar Commission (1952-53)

 মুদালিয়ার কমিশন (1952-53) Mudaliar Commission Secondary Education Commission (1952-1953) মুদালিয়ার কমিশন (1952-53), মাধ্যমিক শিক্ষা কমিশন...